উদ্ভিদের ফিজিওলজিক্যাল রহস্য

Kochu
মানুষ রহস্যপ্রিয় জাতি। সেই আদিকাল থেকেই যেকোন রহস্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ অসীম। রহস্যের দিকে আগ্রহ আছে বলেই রহস্য সমাধানের নিরন্তর চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছে কতক সমাধান হয়েছে আর কতক তিমিরেই আছে এখনো। অবে রহস্যপ্রিয় মানুষ থেমে নেই। রহস্যের সন্ধান পেলেই সেখানে ছুটে যায়, তা যেভাবেই হোক না কেন!!
কচু পাতায় পানি লাগে না এ বিষয়টি ছোট বেলায় দেখে খুব অবাক হতাম কিন্তু বড় হয়ে জানতে পেরেছি কচু পাতায় কিউটিকল নামক মোম জাতীয় পদার্থের পুরো আস্তরণ থাকে তাই পাতায় পানি লেগে থাকেনা। কচু পাতার এই সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে লোককবি রচনা করেছেন…

কচুর পাতার পানি যেমন রে
ও জীবন টলমল টলমল করে
ওই মতন মানুষের দেহা
কখন ঢলিয়া পড়ে জীবন রে …

ফুল কেন রঙিন হয় এই ব্যপারে কৌতুহলের অন্ত ছিলো না, এখনো হয়ত অনেকের মনে এই প্রশ্ন জাগতে পারে। ফুল লাল হওয়ার জন্য দায়ী ক্রোমোপ্লাস্ট নামক পিগমেন্ট। ক্রোমোপ্লাস্টে থাকে ক্রোমোফিল আর এটিই হলো উদ্ভিদ এর কোন অঙ্গের বর্নের জন্য দায়ী। লিউকোপ্লাস্ট বর্নহীনতার জন্য দায়ী আর ক্রোমোপ্লাস্ট বর্নময়তার জন্য দায়ী। এটি ২ প্রকার: ক্লোরোফিল ও ক্রোমোফিল।ক্রোরোফিল সবুজ বর্নের জন্য দায়ী আর বাকি বর্নের জন্য দায়ী ক্রোমোফিল।
Anthocyanin নামক পিগমেন্টের উপস্থিতির জন্য ফুল লাল,পিংক,নীল,পার্পেল রঙের হয়ে থাকে। এছাড়াও Flavanoids নামের ক্যামিক্যাল উদ্ভিদের রঙের জন্য দায়ী। অন্যান্য পিগমেন্ট যেমন carotenoid টমাটো ও গাজরে পাওয়া যায় যা প্লাস্টিডকে হলুদ,লাল ও কমলা রঙ দিয়ে থাকে।
মনে প্রশ্ন আসা খুবই স্বাভাবিক ফুলের এত সুন্দর গন্ধ কেমনে হয় আবার সব ফুলের গন্ধ একরকম হয়না। আর কেনইবা ফুল সুভাস ছড়ায়(!) পরাগায়নে সাহায্য করার জন্য মৌমাছি সহ অন্যান্য কীট পতঙ্গকে আকর্ষণ করার জন্যই ফুল তার সুবাস ছড়ায়। এই ঘ্রাণ সৃষ্টি হয় বাতাসে ফুলের ছড়ানো বেশ কিছু রাসায়নিকের জটিল সংমিশ্রনের মাধ্যমে। যেমন গোলাপের ক্ষেত্রে rwose oxide(যার ৪টি ভিন্ন ভিন্ন isomar আছে)।
লিলির ক্ষেত্রে beta-ocimene ও linalool হচ্ছে সুগন্ধের জন্য প্রধান উপাদান। এছাড়াও ethyl 2-methoxybenzoate ও ফুলের সুন্দর সুবাসের জন্য দায়ী। এজন্যই অনেক ফুল দেখতে একরকমের ও সেগুলোর আকৃতি এবং রঙ এক রকম হলেও কোনো দুটি ফুলের ঘ্রাণ কখনো এক হয় না। এর কারণ হচ্ছে যে-সব রাসায়নিকের সংমিশ্রনে ফুলের ঘ্রাণ সৃষ্টি হয়, সেগুলো বহু বিচিত্র ধরনের এবং সেগুলোয় অনেক ধরনের পরিবর্তন ঘটে ও আলাদা আলাদা।

Lemonতবে সবকিছুর মূল কথা হচ্ছে, ফুল তার ঘ্রাণের মাধ্যমে পরাগায়ন ঘটানোর জন্য কীট পতঙ্গকে সংকেত জানায় আর পরাগায়ন ঘটানোর জন্য তারা পুরষ্কার হিসেবে পায় ফুলের মধু। যে-সব ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ থাকে, সেগুলোর পরাগায়ন ঘটে মূলত: মৌমাছি, প্রজাপতি এবং অন্যান্য পতঙ্গের মাধ্যমে। অন্যদিকে যে-সব ফুলের বাসি ধরনের ঝাঁঝালো গন্ধ থাকে সেগুলোর পরাগায়ন ঘটে গুবরে বা কাঁচপোকার মাধ্যমে। একটা ফুল যখন পরাগায়নের জন্য প্রস্তুত হয়, তখনই সেটির ঘ্রাণ সবচাইতে বেশী হয় এবং সেটি সবচাইতে আকর্ষনীয় হয়ে ওঠে। যে-সব ফুলের ঘ্রাণ দিনে বেশী হয়, সেগুলোর পরাগায়ন ঘটে মৌমাছি এবং প্রজাপতির মাধ্যমে আর যে-সব ফুল মূলত: রাতের বেলা গন্ধ ছড়ায়, সেগুলোর পরাগায়ন ঘটে মূলত: দেয়ালী পোকা এবং বাদুড়ের সাহায্যে
মাথায় শুধু প্রশ্নে ভরপুর ফল পাকলে এর রং পরিবর্তন হয় কেন?
ডিএনএ(ডি-অক্সি রাইবো নিউক্লিক এসিড) কোডিং অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় পর ফলের মধ্যে ইথিলিন সৃষ্টি হতে শুরু করে এবং যখন এর মাত্রা প্রায় 0.1 – 1.0 ppm (পার্সেন্ট পার মিলিয়ন) হয় তখন এর ক্রিয়ায় ক্লোরোপ্লাস্ট ক্রোমাটোফোরে পরিণত হতে শুরু করে। ফলে ফলের সবুজ রঙ পরিবর্তিত হয়ে অন্যান্য রঙ ধারণ করে। এর ফলে ফলের গ্লুকোজ ফ্রুক্টোজে পরিণত হতে শুরু করে। প্রক্রিয়াটি খুবই ধীর প্রকৃতির। এ কারণে রঙ পরিবর্তনও খুব ধীর গতিতে হয়।
ছোট বেলায় মাকে যখন পেঁয়াজ কাটতে দেখতাম তখনই তাঁকে জিজ্ঞাস করতাম কান্না করছ কেন? আমার মা সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারতেন না। যখন উত্তর পেয়েছি তখন মনে হয়েছে অবুঝ বালক তার মাকে কি অবান্তর প্রশ্নটাই না করেছিলো(!) রান্না করার সময় অথবা ডিম ভাজার জন্য আপনি একটা পেঁয়াজ কাটতে গেলেন, আর তখন পেঁয়াজের ঝাঁঝের কারণে আপনার চোখ বেয়ে অশ্রু পড়া শুরু করল! কি ঝামেলার ব্যাপার! কিন্তু এই পেঁয়াজ কাটার সাথে চোখ দিয়ে পানি পড়ার সম্পর্ক কোথায়? কেনই বা এমন ঘটে? মাথায় কি প্রশ্নটা আসেনা?
পেঁয়াজে সালফারযুক্ত বিভিন্ন ধরণের যৌগ থাকে, এর মধ্যে একটি হল অ্যামিনো এসিড সালফোক্সাইড (amino acid sulfoxide)। পেঁয়াজ কাটলে এর কোষের ভেতরের অ্যালিনেজ (allinase) নামক এনজাইম বের হয়ে আসে, যা amino acid sulfoxides যৌগগুলোকে উদ্বায়ী সালফোনিক এসিড (sulfenic acid) এ পরিণত করে, যা চোখের পানির সংস্পর্শে আসামাত্র syn-propanethial-S-oxide নামক যৌগ তৈরী করে, এটিই চোখে পানি আনার জন্য দায়ী। সহজ কথায়, চোখের পানির সংস্পর্শে মৃদু সালফিউরিক এসিড তৈরী হয়, তাই চোখ জ্বালাপোড়া করে। এখানে উল্লেখ্য যে, জ্বালাপোড়ার অনুভূতি কর্ণিয়ার উপরে থাকা free nerve ending (যেখানে অনেকগুলো স্নায়ু একত্রে এসে মিলিত হয়) এর মাধ্যমে মস্তিষ্ক সনাক্ত করে থাকে, তারপর সিলিয়ারি নার্ভ (cilliary nerve) দিয়ে এই অনুভূতি বাহিত হয়ে প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভ (parasympathetic nerves) হয়ে ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড (lacrimal gland)-কে উত্তেজিত করে। ফলে চোখ দিয়ে পানি পড়ে।
তাহলে এ থেকে বাঁচার উপায় কি?

Onion
এই পেঁয়াজকে যদি আপনি ফ্রিজে রাখেন অথবা কাঁটার আগে পানিতে ভিজিয়ে রাখেন, তাহলে পেঁয়াজ কাঁটার সময় আপনার চোখ জ্বালাপোড়া করবেনা এবং এর ফলে চোখ দিয়ে পানিও পড়বেনা। আসলেই মজার ব্যাপার, চেষ্টা করেই দেখুন..
এর কারণ হচ্ছে পানিতে ভিজিয়ে রাখলে পানির সংস্পর্শ পেয়ে সালফোনিক এসিড তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। একই ঘটনা ফ্রিজে রাখার ক্ষেত্রেও হয়। তখন ঠাণ্ডার কারণে সালফোনিক এসিডের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। ফলে সেটি চোখের পানির সংস্পর্শে এসে syn-propanethial-S-oxide যৌগ তৈরী করতে পারেনা। এ কারণে চোখে জ্বালাপোড়াও করেনা।

Appleবাড়িতে অতিথি আগমনের অনেক আগেই আপেল কেটে রেখে দিলে মরিচার মত রঙ হয় তখন এই আপেল অতিথির সামনে পরিবেশন করতে অনেক লজ্জা পেতে হয়। কিন্তু কেন এমন হয়? এই প্রশ্নটি সকলের মাথায় ঘুরপাক খায়। আসুন দেখি কি ঘটনা ঘটে।
লোহাকে(Fe) কয়েকদিন আর্দ্র-বায়ুতে রাখলে অক্সিজেনের দ্বারা জারিত হয়ে লোহার উপরিতল Fe2O3.nH2O নামক যৌগে পরিণত হয়। বাদামী বর্ণের সেই আস্তরণকে আমরা “মরিচা” বলি।
এবার আপেলের কথায় আসি। আপেলের কোষে থাকে বর্ণহীন জটিল ফেনলীয় যৌগ(mono-phenol )। আবার আপেলের কোষের ক্লোরোপ্লাস্টে PPO (PolyPhenol Oxidase) নামক এনজাইম বেশী পরিমাণ থাকে যা বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসলে জারণ বিক্রিয়ায় উত্তম প্রভাবকরুপে কাজ করে। তাই আপেল কেটে খানিকক্ষণ রেখে দিলে PPOএর প্রভাবে আপেলের কোষস্থ ফেনলীয় যৌগ সহজেই জারিত হয়ে বাদামি বর্ণের O-quinon গঠন করে। এই যৌগ পরবর্তী ধাপে অ্যামিনো এসিড বা প্রোটিনের সাথে বিক্রিয়া করে জটিল পলিমারে পরিণত হয়, আর এই পলিমারই সেই বিশেষ ধরনের গাঁঢ় বাদামি রঙ তৈরি করে, যা মরিচার মত দেখা যায়।আপেলের মত এই ক্রিয়া কলাতেও দেখা যায়। কারণ কলাতেও উক্ত এনজাইম বেশি থাকে। এই ধরনের ফল আমাদের শরীরের জন্য খুবই উপকারি।
ছবিঃ ধানমন্ডি ৩২ নম্বর থেকে তোলা।