ইন্দোনেশীয় কৃষক ও Luwak Coffee

কলেজ পড়ুয়া তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সত্তর বছরের বৃদ্ধ লোককেও কফির পেয়ালা হাতে চুটিয়ে আড্ডা দিতে দেখা যায়। প্রাচীন কাল থেকেই কোমল পানীয় হিসেবে কফি মানুষের মন জয় করে নিয়েছে।বর্তমান আধুনিক সভ্যতায় কফি ছাড়া কাউকে আপ্যায়নের কল্পনাই করা যায় না। কফি মূলত Rubiaceae পরিবার ভুক্ত সপুষ্পক পেরিনিয়াল গুল্ম জাতিয় উদ্ভিদ যার বৈজ্ঞানিক নাম Coffea arabica L. ধারনা করা হয় আরবের কোন দেশে প্রথম কফির চাষাবাদ শুরু করা হয়েছিলো এবং সেই ধারনা থেকেই এর স্পেসিসের নামকরন করা হয়েছে arabica যার প্রথম বর্ণনা করেন ফ্রেঞ্চ প্রকৃতিবিদ Antoine de Jussieu এবং তিনি প্রথম এর নামকরন করেছিলেন Jasminum arabicum, তারপর এই স্পেসিমেন নিয়ে আমস্টারডামের বোটানিক্যাল গার্ডেনে অনেক গবেষনা করা হয় এবং কার্ল লিনিয়াস ১৭৩৭ সালে একে নতুন গন Coffea তে স্থান দেন।

এক সময় আমরা চা এর শুধু মাত্র একটি ভ্যারাইটি বাজার থেকে কিনে আনতাম কিন্তু আজকাল বিভিন্ন রকমের সুগন্ধি চা বাজারে পাওয়া যায় তা নিশ্চই আপনারা জানেন। তেমনি কফি নিয়ে বিভিন্ন গবেষনা চলছে কিভাবে একে স্বাদে ও গন্ধে আরো উন্নীত করা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় বহুকাল আগে থেকেই ইন্দোনেশিয়ায় বিশেষ পদ্বতি অনুসরন করা হচ্ছে এবং সফলতার সাথে সারা বিশ্বে সরবরাহ করছে। তারা Luwak Coffee বা Cat Poop Coffee নামে এক প্রকার বেশ দামী কফি আবিস্কার করেছে যা বহুদিন যাবৎ বাজারে পাওয়া যায়। Luwak বা cat poop হলো বিশ্বে খুবই দুস্প্রাপ্য ও দামী এক প্রকার কফি যার প্রতি কাপের মুল্য ৮০ মার্কিন ডলার বাংলাদেশী টাকায় যার মূল্য ছয় হাজার চার শত টাকা।

১৭০০ শতাব্দির প্রথম ভাগে ইন্দোনেশীয় কৃষকরা ডাচ দের কফি বাগানে কাজ করতো ও কফি চাষ করতো। উৎপাদিত সব কফি বিন তখন ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করা সম্পুর্ন নিষেধ ছিলো কারন সরাসরি ইউরোপে পাঠিয়ে দেয়া হতো নিজের দেশের জন্য কিছুই রাখা সম্ভব হতো না। এই পরিস্থিতিতে তখন ইন্দোনেশীয় কৃষকরা উৎপাদিত কফি বিন সংগ্রহ করে খাট্টাস জাতিয়(বিড়ালের মত এক প্রকার প্রানী যাকে ইংরেজিতে Civet Cat বলা হয়) প্রানীদের খাবার হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্বান্ত নিলো কারন এই ভাবে যদি কিছু কফি বিন নিজেদের জন্য রাখা যায়। খাট্টাসের পাকস্থলী তে শুধু কফি বিনের উপরের Pericarp টি ডাইজেস্ট হয়ে বিস্টা বা পায়খানার সাথে শক্ত বিন গুলো বের হওয়ার পরে তা সংগ্রহ ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে নিজেদের চাহিদা পুরন করতো।

ডাচ রা এই পরিস্থিতি বুঝতে পেরে Civet Cat নিধনে মনোনিবেশ করলো কিন্তু তৎকালীন সময়ে এদের বিস্তার এত বেশী ছিলো যে নিধন করেও এদের রোধ করতে পারেনি। উপায় না দেখে ডাচ রা Civet Cat এর বিস্টা থেকে কফি বিন সংগ্রহ করে তা দিয়ে পরীক্ষামূলক ভাবে কফি বানিয়ে দেখলো বিন থেকে সরাসরি যে কফি পাওয়া যায় তা থেকে খাট্টাসের বিস্টা থেকে সংগৃহীত বিন দিয়ে তৈরি কফির এ্যরোমা স্বাদ অনেক বেশী। ব্যাস ডাচ দের কাছে Civet Cat এর কদর বেড়ে গেলো কিন্তু বেচারা ইন্দোনেশীয় কৃষক তাদের কোন কুলই রক্ষা হলো না।

Civets Cat কফি বিন খেতে পছন্দ করে। বিন এদের ডাইজেস্টিভ সিস্টেমে যাওয়ার পর fermentation সহ আরো অনেক রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়া ঘটে। বিড়ালের পাকস্থলী নিসৃত প্রোটিওলাইটিক এনজাইম কফি বিনের উপর চুঁইয়ে পড়ে যার ফলে পেপটাইড উৎপন্ন হয় ও এমাইনো এসিডের প্রাচুর্যতা দেখা যায়। ফলে অনন্য সুবাস ও এ্যরোমা যুক্ত কফি পাওয়া যায়। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বিন গুলোকে Luwak কফিতে পরিনত করা হয়।

অনেকের ধারনা অনন্য স্বাদ গন্ধ ও এ্যরোমার জন্য নয়, শুধু এর অনন্য গল্পের কারনেই এই কফি এত বিক্ষাত হয়েছে বা সারা পৃথিবীতে এর চাহিদা এত বেশী বেড়েছে। আমি এর গল্প শুনে অল্প অল্প ভালোবেসেছিলাম তাই ইন্দোনেশিয়া সফরকালে এক পেয়ালা পান করার সুযোগ নিয়েছিলাম যদিও এটি আমার জন্য বিলাসিতা ছিলো তাতে কি পৃথিবী বিক্ষাত কফি বলে কথা! হয়ত অনেকে আমার Luwak কফি পানের কথা জেনে “ওয়াক থু” ও ছি ছি করছেন। সুধী পাঠক সাধারন কফির তুলনায় Luwak কফির টেস্ট ৫০ গুন বেশী এককথায় অসাধারন! অসাধারন!! অসাধারন!!! তার চেয়েও অসাধারন ইন্দোনেশীয় কৃষক ভাইয়েরা কারন এই অবদান তাঁদের।

ছবিঃ গুগলের সৌজন্যে।