প্রকৃতির অলংকার বনজুঁই

লেখক- আজহারুল ইসলাম খান।

“যেথা যত ফুল আছে বনে বনে ফুটে
আমার পরশ পেলে খুশি হয়ে উঠে”।
কবিগুরু এভাবেই বনফুল নিয়ে তাঁর মনের আকুতি প্রকাশ করেছেন। আমি সুযোগ পেলেই একা একা বনফুলের খোঁজে বের হয়ে যাই এরই ধারাবাহিকতায় গত শুক্রবার বের হয়েছিলাম বনফুলের সৌরভ ও সৌন্দর্য উপভোগ করতে। ঘুরতে ঘুরতে বনজুঁই এর দেখা পেলাম। মনযোগী হলে আপনিও এর রূপে মুগ্ধ হবেন। এর মিষ্টি গন্ধ আপনাকে মাতাল করে তুলবে। ফুলের কারুকাজ তথা পুংকেশর,পাপড়ি,বৃতি, পাতা ও কান্ডকে প্রকৃতি এতোটাই নিখুঁত ভাবে সাজিয়েছেন যে আপনি যদি এই ফুলকে বিশ্লেষন করতে শুরু করেন তাহলে বিশাল একটা বই হয়ে যাবে তবু শেষ করা যাবে না।

ছবির বিষয়বস্তুঃ
১ নং ছবি Aamaya Khan.কতৃক ধারনকৃত যেখানে প্রস্ফুটিত বনজুঁই দেখানো হয়েছে। ২ ও ৩ নং ছবিতে বনজুঁই এর ফল দেখানো হয়েছে যা গুগল থেকে সংগৃহীত এবং ৪ নং ছবিতে বনজুঁই এর পুংকেশর দেখানো হয়েছে এই ছবিটিও গুগল থেকে সংগৃহীত।

রাস্তায় চলতে প্রায়ই চোখে পড়বে অযত্নে অবহেলায় অনেক প্রতিকুলতার মধ্যে প্রকৃতির অলংকার হিসেবে বেড়ে উঠা এক গুল্ম জাতিয় পেরিনিয়াল উদ্ভিদ বনজুঁইকে। এর আরো কিছু নাম আছে, যেমন ভাইট, ভাট ও ঘেটু বলেও অঞ্চলভেদে অনেকের কাছে পরিচিত। বিশেষ করে পতিত ভুমি, জঙ্গলের কিনারা, বড় রাস্তার কিনারা এদের প্রিয় আবাসস্থল। বসন্তকালে গাছের অগ্রভাগে ও পার্শিয় শাখা প্রশাখায় অসংখ্য সাদা ও বেগুনি মিশ্রিত রঙে বনভূমিকে সাজিয়ে তোলে। ফুলের মাঝখানে থাকা লম্বা পুংকেশর এই ফুলের সৌন্দর্যকে আরো বৃদ্ধি করেছে ও মনোমুগ্ধকর সৌরভে প্রজাপতি ও মৌমাছির নাচন যেন প্রকৃতিতে এক ভিন্নমাত্রা এনে দেয়। ফুলের পাপড়ি ঝরে পড়ার পর লালচে বৃতির মাঝখানে সবুজ ও বেগুনী বীজ দেখতে একেবারে নাকফুলের মত, মনে হয় যেন কারুকাজ খচিত লালচে পাথরের মাঝে সবুজ অথবা গাঢ় বেগুনী চকচকে আরেকখান ডায়মন্ড খন্ড বসিয়ে রেখেছে।

ইংরেজ সাহেবরা এর সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে নামকরন করেছিলেন Hill glory bower. ইংরেজী নামটি এর বাসস্থান ও সৌন্দর্যের সাথে একেবারে মিলে যায়। ১৭৫৩ সালে কার্ল লিনিয়াস তাঁর স্পেসিস প্লান্টেরাম নামক গ্রন্থে এই জেনাসের (Clerodendrum) নাম উল্লেখ করেন যা দুটি গ্রীক শব্দ যথাক্রমে Kleros ও Dendeon থেকে উৎপত্তি। Kleros মানে হলো Chance অথবা Fate অথবা Clergy এবং Dendron মানে হলো Tree, সুতরাং বাংলায় এই জেনাস কে বলা যেতে পারে “ভাগ্য উদ্ভিদ”। সকল পাঠকের মনে একটা প্রশ্ন হয়ত উকি দিবে কেন এর নাম ভাগ্য উদ্ভিদ হবে!! এদের বৃতি সাদার বদলে প্রথমে সবুজ ও পরে পরিপক্ক অবস্থায় লালচে রঙ ধারন করে।  এই লালচে রঙের কারনেই এদের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটে অর্থাৎ অল্প সময়ের মধ্যে ফুলের বৃতিতে যে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় তার জন্য পলিনেটর আকৃষ্ট হয় ও পরাগায়ন ঘটায়, কারো কারো মতে এজন্যই কার্ল লিনিয়াস এরকম নামকরন করেছেন।

এটি (Clerodendrum infortunatum) বহুবর্ষজীবী Lamiaceae পরিবারের গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ তবে বিজ্ঞানিরা কখনো কখনো একে Verbenaceae পরিবারের আওতাভুক্ত করে শ্রেনীবিন্যাস করেছেন। প্রায় ৪০০ প্রজাতির বনজুঁই আছে যাদের আদিনিবাস এশিয়া মহাদেশের বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা।

ভেষজ গুণে গুণান্বিত এই গুল্ম ম্যালেরিয়া, চর্মরোগ ও পোকা-মাকড়ের কামড়ে খুবই উপকারী। এই উদ্ভিদের কচি পাতার রস টনিক হিসেবে কাজ করে। পাতায় প্রাপ্ত ক্যামিকেল oleic acid, stearic acid ও lignoceric acids, tannin, glucuronide ও gallic acid যা কৃমিনাশক,জ্বর উপশমকারি ও এক্সপেকটোরেন্ট হিসেবে চমৎকার ফলপ্রসু। মূল থেকে প্রাপ্ত উপক্ষার lupeol ও ß-sitosterol, antifungal flavonoids, cabruvin ও quercetin যা এজমা, টিউমার ও চর্মরোগের ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয় এছাড়াও ইমপোটেন্সি বা যৌনদুর্বলতায় মুলের উঞ্চ রস পুরুষাঙ্গে মালিশ করে চমৎকার ফলাফল পাওয়া যায়।
Singha et al 1993 & Anwar et al 1994 এর মতে কচি পাতার Alcoholic নির্যাসে খুবই কার্যকরি ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক নাশক উপাদান বিদ্যমান।

টীকাঃ
★ফ্ল্যাভোনয়েড(Flavonoids)–উদ্ভিদের খুবই গুরুত্ববাহী রঞ্জক (Pigment) যাহা ফুলের রঙ তৈরী করে, পলিনেটরদের আকৃষ্ট করার জন্য ফ্লাভোনয়েড হলুদ,লাল ও নীল রঙের পাপড়ীর ডিজাইন তৈরী করে। কিছু উঁচু (Higher plants) শ্রেনীর উদ্ভিদে ফ্ল্যাভোনয়েড UV (আল্ট্রা ভায়োলেট) রেডিয়েশান কে ফিলট্রেশন করতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও ফ্ল্যাভোনয়েড উদ্ভিদের রাসায়নিক মেসেঞ্জার,শারীরবৃত্তীয় নিয়ন্ত্রক এবং সেল(Cell) চক্র ইনহিবিটরের কাজ করতে পারে।
★এক্সপেকটোরেন্ট–এক ধরনের মেডিসিন যা দ্রুত কফ নিঃসরনের জন্য সেবন করা হয়।

সতর্কীকরণঃ যে কোনো ভেষজ ঔষধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।